রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩১ অপরাহ্ন
কালের খবর ডেস্ক : মিনু। বয়স ১৩ বছর। গ্রামের বাড়ি বগুড়ার বাউলপাড়া। ৪ ভাইবোনের মধ্যে মিনু তৃতীয়। বাবা নূর ইসলাম মহাস্থানগড়ে ফুটপাথে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। মা তানজিলা গৃহিণী। এক বছর আগে মিনুর বাবা অনেক ধারদেনা করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। সেখানে যাওয়ার পরপরই দালালরা তার সঙ্গে নেয়া টাকা পয়সা এমনকি নিজের পাসপোর্টটি পর্যন্ত নিয়ে যায়। এরপর ভাগ্যের জোরে গ্রাম থেকে মুক্তিপণের টাকার বিনিময়ে ৪০ দিনের মাথায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মিনুদের পরিবারে নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া। অভাবের সংসারে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেন নি মিনু। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে বাবার দেনার টাকা শোধ করতে ৬ মাস আগে বগুড়ার স্থানীয় একটি বেকারিতে সপ্তাহভিত্তিক কাজ শুরু করেন।
মিনু বলেন, বেকারিতে কাজ করে যে টাকা পেতাম তা দিয়ে বাবার বিদেশ যাওয়ার টাকার সুদের কিস্তি পরিশোধ করতাম। কিন্তু কিস্তির টাকা দিলে তো আর পেটে খাবার জোটে না। তাই চাচাতো বোন লাভলীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসি। গত এক মাস আসে লাভলী মিনুকে একটি হোস্টেলে গৃহপরিচারিকার কাজ জুটিয়ে দেন। এখানে তার বেতন ধরা হয়েছে ৪ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া মালিকের। মিনুর কাজ হচ্ছে তিনবেলা কাঁচা সবজি কাটা, মাছ কাটা, টেবিল মোছা ও মেয়েদের টুকটাক বাজার করে দেয়া। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই নার্সারিতে পড়ে। হোস্টেলে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মিনু বলেন, আগে কখনো ঢাকায় আসিনি। এখানে কাজ করতে এসে ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে মা আর ছোট ভাইয়ের জন্য মন খারাপ হয়। স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়।
মমতাজ বেগম। বয়স ২০ বছর। বাড়ি বগুড়া সদর শিবগঞ্জের বালুপাড়া। দুই বোনের মধ্যে মমতাজ বড়। এক বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যায়। ৮ বছর আগে ১১ বছর বয়সে একই এলাকার উজ্জলের সঙ্গে বিয়ে হয় মমতাজের। উজ্জল পেশায় কৃষক। বিয়ের পরপরই যৌতুকের জন্য নিয়মিত মারধর করতো উজ্জল। বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে ছিল অবৈধ সম্পর্ক। শেষবার মমতাজকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলে বাবার বাড়ি চলে আসে। এরপর আড়াই বছরের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় ডিভোর্স হয়ে যায় মমতাজ ও উজ্জলের। মমতাজের মেয়ের বয়স এখন সাড়ে ৬ বছর। নাম রেশমি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বগুড়ায় নানির কাছে থাকে। মেয়ের পড়ালেখা ও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ৩ মাস আগে প্রতিবেশী চাচার বান্ধবীর সঙ্গে ঢাকায় আসেন মমতাজ। চাচার বান্ধবী একটি হোস্টেলে বুয়ার কাজ করেন। মমতাজকে তিনিই একটি বাসায় বাধা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। বেতন সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এটা দিয়ে মেয়ের পড়ালেখার খরচ ও মায়ের সংসার খরচের টাকা পাঠান তিনি। পাশাপাশি একই বিল্ডিংয়ে ৩ থেকে ৪টা মেসের চাকরিজীবী মেয়েদের ছুটা কাজ করেন। রান্নায় ৫শ’, কাপড় ধোয়া ৫শ’, ঘর ঝাড়ু ও মোছা ৫শ’ টাকা। এ ছাড়া মেয়েদের প্রয়োজনীয় বাজার করা, মাথায় মেহেদী দিয়ে দেয়া, তেল মেখে দেয়া বাবদ তার কিছু উপরি উপার্জন আছে। মালিকের বাসা থেকে মাঝেমধ্যে যে ডিম খেতে দেয়া হয় তা জমিয়ে পাশের মেসের মেয়েদের কাছে বিক্রি করেন মমতাজ। সব মিলিয়ে সে মাসে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার টাকা পান। মমতাজ বলেন, আরো মাস ছয়েক কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে মা ও মেয়ের কাছে গ্রামে চলে যাবো। সেখানে গিয়ে কয়েকটা গরু-ছাগল ও সুদে টাকা খাটাবো।
পান্থপথের গ্রিনরোডে কাজ করেন রাবেয়া বেগম। বয়স ১৫ থেকে ১৬। সরকারি চাকরিজীবী একটি পরিবারে গত ৮ বছর ধরে ছুটা কাজ করছেন রাবেয়া। ১৩ বছর বয়সে এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। পরবর্তীতে বনিবনা না হওয়ায় তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন রাবেয়া। স্বামী রিকশা চালায়। আড়াই বছর বয়সী একটি পুত্র সন্তান আছে তার। চাকরিজীবী এই বাসায় রাবেয়া তিনটি ছুটা কাজ করেন। জামা কাপড় ধোয়া, থালাবাটি ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া ও ঘর মোছা। প্রতিটি কাজের জন্য আলাদাভাবে ৫শ’ করে মাসে মোট ১৫শ’ টাকা নেন। এভাবে আরো ৪ থেকে ৫টা বাসায় ছুটা কাজ করেন। তার এক কথা বাধা কাজে পোষায় না। বাবা-মা ও স্বামী-সন্তান নিয়ে একটি বস্তি এলাকায় ভাড়া থাকেন। প্রতিমাসে সাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা পায় রাবেয়া। সুন্দরী ভাবি। আসল নাম মায়া বেগম। তার আরো একটি নাম আছে। ধলি। দেখতে অনেক ফর্সা ও সুন্দর হওয়ায় অনেকেই তাকে ধলিভাবি বা সুন্দরী ভাবি বলে ডাকেন। রাজাবাজার এলাকায় কাজের বুয়া মহলে তার অনেক খ্যাতি। এক কথায় ধলি বা সুন্দরী ভাবি বলতে সবাই চেনেন। সুন্দরী ভাবির নানি বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। তার মা’ও বাসাবাড়ি ও মেসে কাজ করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ব্যাচেলর ছেলেদের মেসে বুয়ার সংকট মানেই সুন্দরী ভাবিকে স্মরণ করো। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান। বাসাবাড়িতে কাজের পাশাপাশি সে বিভিন্ন বাসায়, মেসে ও হোস্টেলে বুয়া সাপ্লাইয়ের কাজ করে। সুন্দরী নামেমাত্র বাসাবাড়িতে কাজ করেন। তার মাসিক আয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। যার অধিকাংশই আসে বুয়া সাপ্লাইয়ের কাজ থেকে। সুন্দরী ভাবির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সিনিয়রিটিও যেন বাড়ছে। এলাকায় নতুন কোনো বুয়া কাজে আসলে সবার আগে তার কাছে খবর চলে আসে। অন্য বুয়ারা তাকে আদব কায়দা ও সমীহ করে চলেন। দিনের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যার পরে গ্রিনরোডের আইবিএ হোস্টেলের সামনের চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে আর পান খেয়ে সময় কাটান ধলি। নিজের জমানো টাকা দিয়ে স্বামীকে ফুটপাথে একটি চায়ের টং দোকান দিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলেমেয়ে। সবাই বিয়ে করে যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছেন।
নগরজীবনে ব্যস্ততার ছকে বাঁধা খাওয়া-দাওয়াসহ প্রাত্যহিক অনেক অনিবার্য কাজের জন্য ঢাকাবাসীর অন্যতম ভরসার জায়গা গৃহকর্মী, যারা ‘কাজের বুয়া’ নামেই বেশি পরিচিত।
চলতি বছরের একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকায় গৃহকর্মীর সংখ্যা কমপক্ষে ৫ লাখ। এই জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে ব্যস্ত নাগরিকদের জীবনমান। গৃহকর্মীরা সাধারণত আবাসিক থেকে অর্থাৎ কোনো বাড়িতে থেকেই কাজ করে, যাদের প্রচলিত বাংলায় ‘বান্ধা বুয়া’ বলে। আর কয়েকটি বাড়িতে ঘুরে ঘুরে যারা কাজ করে তাদের ‘ছুটা বুয়া’ বলা হয়। গৃহকর্মীর নিয়োগ হয় পুরোটাই অনানুষ্ঠানিক বা আশেপাশের গণ্ডির সূত্র ধরে। যদিও গত কয়েক বছরে কিছু অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গৃহকর্মী সরবরাহ-সেবা শুরু করেছে। অফিস কিংবা বাড়ির জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী নির্ধারণ করা যায়। আর এক্ষেত্রে একেবারে নতুন সংযোজন অ্যাপভিত্তিক গৃহকর্মী সেবা। যারা আবাসিক থেকে কাজ করেন তাদের বেতন নির্ধারণ হয় একেবারেই অনানুষ্ঠানিকভাবে। ছুটা বুয়াদের ক্ষেত্রে কাজ অনুসারে টাকার পরিমাণ নির্ধারণ হয়। অ্যাপভিত্তিক বা ওয়েবসাইটভিত্তিক গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে রয়েছে বেতনের সুস্পষ্ট কাঠামো। রোবটডাকো ডটকম নামের এই অ্যাপের মাধ্যমে ৩০ মিনিটেই গৃহকর্মী পাওয়া যাবে। প্রতি ঘণ্টা কাজের জন্য এই গৃহকর্মীদের মজুরি হবে ১০০ টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর-২০১৪ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী গৃহকর্মে নিয়োজিত এক লাখ ২৫ হাজার শিশুকর্মীর বয়স পাঁচ থেকে সতের বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ মেয়ে শিশু। আর ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশে ১৫ বছর বয়সের উপরের প্রায় ৯ লাখ শিশু গৃহকর্মী রয়েছে। এদের আবার ৮৩ শতাংশ মেয়ে শিশু। যাদের বয়স ১৮ এর নিচে। এই বিপুল সংখ্যক গৃহকর্মীর সার্বিক কল্যাণ ও গৃহকর্মকে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, ২০১৫ সালের ২১শে ডিসেম্বর ‘গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা-২০১৫’-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। এই নীতিমালায় গৃহপরিচারিকাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
দেশে গৃহকর্মীর সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে লেবার ফোর্স সার্ভে-২০১০ অনুযায়ী, সংখ্যাটি প্রায় ১৪ লাখ। গৃহকর্মীদের অধিকাংশই নারী, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গৃহকর্মী শিশু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ-২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী গৃহকর্মে নিয়োজিত মোট শিশু (৫-১৭ বছর) শ্রমিক হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই মেয়ে শিশু।